পাখি পাঠের প্রথম-ভাগ

BOOK REVIEW
Subhadip Mandal Adhikary
পাখি পাঠের প্রথম-ভাগ পাখি-সব, জীবন সর্দার
বোধোদয় গ্রন্থমালা

একদম নতুন কিছু শেখার সময় গোড়ার দিকে সকলকেই কম-বেশি বেগ পেতে হয়। শুরুতেই ক্লান্তিকর ব্যাকরণচর্চা। খুব কঠিন বোধ হলে ধৈর্যচ্যুতিও ঘটতে পারে। পরিণাম – বিষয় থেকে মানসিক দূরত্ব বাড়ে, এমনকি চর্চাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় ‘সহজপাঠ’-এর গুরুত্ব বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। ওই যে ছোটবেলায় মা যেমন ‘কাগের দলা- বগের দলা’ করে খাওয়াতো আমাদের সেইরকমই পরম যত্নআত্তি করে প্রকৃতিপাঠের মতে বিষয়টিকে সত্তর-আশির দশকে বাঙালির ঘরে ঘরে কিশোর- কিশোরীদের সামনে তুলে ধরেছিলেন জীবন সর্দার। একটানা চল্লিশ বছর ধরে সন্দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছে ‘প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর’- যা আশেপাশের ঝোপঝাড়, বনজঙ্গলের প্রতিবেশীদের জন্যে কচিকাঁচা-দের মনে স্থায়ী জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। তাঁর লেখা এক অখ্যাত বই ‘পাখি সব পাখি পাঠের প্রথমভাগ বললেও অত্যুক্তি হয়না।

প্রথম ভাগ বলব কেন ?? আসুন কয়েকটা সহজ কথা দিয়ে জীবনবাবুর ভাষাতেই বোঝানো যাক – ‘পাখি দেখার জন্য প্রথমেই কোনো যন্ত্রের দরকার হয়না। দরকার “চোখ কান হাত মাথা, আর চাই পেনসিল খাতা”। পাখিরা নিজেরা তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনা। তাই, যা দেখা যায় তাই-ই লিখে রাখতে হয়। নিজের মন থেকে বানিয়ে কিছু নয়। ঠিকঠাক বিবরণ লেখা খাতাটি একটি জ্ঞানের ভাণ্ড হয়ে যায়। একদিন ওটা থেকে পাখির বিষয়ে বহু খোঁজখবর মেলে’।
“চাতককে বলা যায় ‘বর্ষার পাখি’। ধারণা করা হয় পাখিটি আফ্রিকা থেকে সে সময় আসে এদেশে। আজ ডাক শুনে দেখলাম, তো কাল সেই সময়ে আর দেখা নেই। পাখি চেনার জন্য শুধু চোখ নয়, কানকেও সজাগ রাখতে হয়। শুধু ডাক বা গান শুনে পাখি চেনার জন্য সময় ও ধৈর্যের দরকার। কিছুদিন ডাক আর গান শুনে পাখি চেনায় দক্ষ হলে, মনে হয়, চোখের চেয়ে কান অনেক বেশি নির্ভরশীল। চোখে না দেখে শুধু ডাক শুনেই অনেকে বলে দিতে পারেন কী পাখি ডাকছে”- আজকের দিনে এই পদ্ধতির অনুশীলন বিরল। এখন পাখি চেনা বলতে লং টেলিফোকাল লেন্সে তোলা পাখির ছবি ক্যামেরা ডিসপ্লে বা কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখে গ্রিমেটের (Birds of the Indian Subcontinent Book by Carol Inskipp, Richard Grimmett and Tim Inskipp) পাতা উল্টে মিলিয়ে নেওয়া। ইন্টারনেটের যুগে দুনিয়া তো হাতের মুঠোয়! তথ্যও সহজলভ্য! জীবনবাবু শুরুতেই একটি সহজ মৌলিক প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন- একটা পাখিকে না হয় বাইরে থেকে ‘চেনা’ হয়ে গেল, কিন্তু সকাল থেকে রাত অবধি করে কী ? বারোমাসে ছয়ঋতুতে কোথায় থাকে, কী খায়? পাখিরা পাখি কেন? মানুষের সাথেই বা তাদের সম্পর্ক কী? পাখিরা এলো কিভাবে? এই আলোচনা দিয়েই শুরু প্রথম অধ্যায়- ‘খনি থেকে ঘুলঘুলিতে’।
স্পেন, ফ্রান্সের গুহায় যে ছবিগুলো মানুষ এঁকেছিল, তার বয়স সতেরো বা আঠারো হাজার বছর। তাহলে আঠারো হাজার বছর আগেই মানুষ পাখির চর্চা শুরু করে দিয়েছিল। বিবর্তনের লম্বা যাত্রা পথে পাখি পর্বের সূচনা প্রাগৈতিহাসিক সময়ে।

GROWDERS SODETECTOR
চার্লস ডারউইন তাঁর বিরলযাত্রার উপলব্ধি সম্বল, পৃথিবী ওলোট-পালোট করে দেওয়া সেই ‘ওরিজিন অব স্পিসিজ’ বইটি যে বছর লিখেছিলেন, ঠিক তার দু’বছর বাদেই, ১৮৬১ সালে জার্মানির বেভেরিয়ার একটি স্লেট পাথরের খনি থেকে প্রথম ফসিলটি পাওয়া গেল। সরীসৃপজাতীয় প্রাণী থেকে পাখিরা ধীর ও
ধারাবাহিকভাবে ক্রমবিবর্তিত হয়েছে – এটা তার স্পষ্ট প্রমাণ। যদিও সেই ফসিলে মাথা ছিল না বটে, কিন্তু পালক ও ডানার ছাপ অবিকৃত ছিল। এরপরেও প্রত্নজীববিজ্ঞানীরা ১৮৭৭ সালে একটা গোটা ডানা, পরে ১৯৫৬ সালে তৃতীয়বার আরও একটি ফসিল খুঁজে পেলেন – নাম দিলেন ‘আদি পাখি’। ফসিলগুলো প্রায় তেরো কোটি বছরের পুরানো। আজকে বাড়ির ঘুলঘুলিতে যে চড়াই-কে আমরা দেখি, বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে খনি থেকে ঘুলঘুলিতে আসতে তার সময় লেগেছে প্রায় পনেরো কোটি বছর!

পরের অধ্যায়গুলোতে বিভিন্ন পাখির পালকের রং ও আকার, ডানার গঠন বৈচিত্র্য, ঠোঁটের গড়ন ছবিসহ আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো খুঁটিয়ে দেখব কেন ? ধরা যাক, বাড়ির
পেছনে আমবাগানে বুলবুলি, বেনেবউ, ফটিকজলের ডাক শুনছি। হঠাৎ আমগাছের ডালে একটা পাখি নজরে এলো। ঠোঁট থেকে গলা, বুক, লেজের তলা পর্যন্ত হাল্কা সাদা খয়েরি রং। চোখ বন্ধ করে পাতাহীন গাছের ডালের সমান্তরালে এমন অদ্ভুত কায়দায় শরীরটাকে বসিয়েছে, মন দিয়ে না দেখলে গাছের ডাল ভেবেই ভুল হওয়ার কথা। পায়ের গড়ন পেঁচার মতো হলেও ততটা মজবুত নয়, অর্থাৎ শিকারি পাখি বলে মনে হচ্ছে না! হ্যাঁ, এখন বাড়ি এসে বই পড়ে বেশ বোঝা যাচ্ছে পাখিটার নাম Indian Nightjar, বাংলায়-‘ছেপা’। নবীন পাখি পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে জীবনবাবু এই রকমই পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির পরামর্শ দিয়েছেন। নোট বই আর পেনসিল নিয়ে পাখিদের দিনলিপি, বাসা তৈরি, আচরণ লিখে রাখার পাশাপাশি ছোট ছোট অনেক পরামর্শ দিয়েছেন- কোন পাখি কখন কোথায় দেখা যাচ্ছে, তারা কি সারাবছরই থাকে নাকি বিশেষ ঋতুতে আসে? এইসব প্রশ্নের উত্তর আমরা যেন খোঁজার চেষ্টা করি।
বই থেকে কয়েকটা লাইন সরাসরি লিখে দিলাম- নাম ধরে ধরে পাখি চেনার চেষ্টা না করাই ভাল। পাখির গড়ন ধরন দেখে লিখে নিয়ে পরে নাম জেনে নিলেও চলে। একই পাখির ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন নাম, তাই বিবরণ ঠিক হওয়া চাই’।
১৯৮০ সালে বর্ণপরিচয় গ্রন্থপ্রকাশের ১২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বোধোদয়” গ্রন্থের নামে পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি ‘প্রকৃতি আর মানুষ’ বইয়ের একটি সিরিজ প্রকাশ করে। যিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনিই সেই বিষয়ে লিখবেন। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, লীলা মজুমদার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ডঃ দিলীপ সিংহ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক সত্যের সন্ধানে আধুনিক মানুষের সাধনার ক্ষেত্র এখন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হয়ে চলেছে। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিচিত্র প্রবাহের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যপূর্ণ করার জন্য এই গ্রন্থমালার পরিকল্পনা।
Subhadip Mandal Adhikary is a Teacher by profession and a nature enthusiast, resides in Tamluk, West Bengal.