Skip to content

শক্তিশালী পাখিরা

“দিকে দিকে পাখি পাতা, জাল নয়” জয় গোস্বামীর এই কবিতার লাইনটি সবসময় মনে পড়ে, যখন ভারতবর্ষে রেকর্ড হওয়া পাখির সংখ্যার দিকে তাকাই। ১২৫০টির মতন রেকর্ড সারা ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গেই একা ৮৪৯ টি। এই বিপুল পরিমান পাখির বৈচিত্র্য সম্ভব হয়েছে, কারণ ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। শুধু আমাদের রাজ্যের কথাই যদি ধরি, উত্তরে হিমালয় এবং তার পাদদেশে বিশেষ ধরণের হিমালয়ান পক্ষীকুল, গাঙ্গেয় অববাহিকা কিংবা দক্ষিণের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির পাখির বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। এই বিস্তার বিভিন্ন ঋতুতে পরিবর্তন হয়। মানে গরমে যাদের দেখবেন, শরৎকালে আবার তাদের অনেকেই থাকবে না, বদলে যোগ হবে আরো নতুন কিছু। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা একটি সতত ঘূর্ণায়মান চক্রের মতন।

Shikra

পাখি কথাটা শুনলেই মনে আসে একটি ছোট্ট মিষ্টি নরম তুলতুলে চিত্র কিন্তু বাস্তবে পাখির শরীর নরম পালকে মোড়া হলেও সবসময় তাদের সম্বন্ধে ওই দুষ্টু মিষ্টি উপাধিটা ঠিক খাপ খায় না। বিবর্তনের পথ ধরে সেকেলে ডাইনোসরের জ্ঞাতি গুষ্টি আজকাল পাখপাখালির রূপ ধরে আমাদের চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আপনার বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে এসে বসা চড়াই, কার্ণিশের দোয়েল, ছাদের টুনটুনির ইনোসেন্ট মুখগুলো চোখের সামনে ভাসছে তাই তো? আর ভাবছেন এ আবার কিসব অনাসৃষ্টি কথা! তাহলে আসুন যাদের আমরা আপাতঃ ভাবে শক্তিহীন ভাবি তাদের স্ট্যামিনার কয়েকটা নমুনা জেনে নেই। 

Osprey

বাস্তুতন্ত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হলো শিকারী পাখিদের। বিভিন্ন ধরণের বাজ, চিল, ঈগল ইত্যদিরা ছোট পাখি, সরীসৃপ বা অনেকসময় ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীও শিকার করে লাঞ্চ, ডিনার সারে। কিন্তু এরা ছাড়াও টুকটাক শিকার আরো অনেকেই করে। হোয়াইট ব্রেস্টেড কিংফিশার আমাদের রাজ্যের রাজ্যপাখি।আশেপাশে খুবই দেখা যায়। জলের পাশে বসে থাকে। আপনি ভাবলেন ও তো বসে বসে মাছের হিসেব করছে। কিন্ত ওরা মাছ না পেলে টিকটিকি বা ছোট পোকা মেরে খায়। অনেকসময় ছোট পাখিও মেরে খায়, কিন্তু তথাকথিত ভাবে এরা শিকারী পাখির তকমা পায়নি। শুধু মাছরাঙা নয়, স্রাইক বা কাজলপাখিও ছোট সরীসৃপ মেরে অবলীলায় পেটে চালান করে।

Purple Heron with snake kill
Black-headed Ibis with frog kill

বক বা ষ্টর্ক জাতীয় পাখি সারাদিন তীক্ষ্ণ চোখে জলের দিকে চেয়ে বসে থাকে। মাছ বা গেঁড়ি গুগলিই জোটে। কিন্তু মাঝে মাঝে সরেস সাপ বা সতেজ ব্যাঙ ও জুটে যায়। ছবিতে দেখুন পার্পল হেরণ এবং কাস্তেচড়ার মুখে ‘মধ্যবিত্তের মাসের শেষে বিরিয়ানী খাবার আনন্দ’ উপচে পড়ছে।

Black-winged Kite

এবার আসি যারা সত্যি শিকারী পাখি, তাদের প্রসঙ্গে। আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় ব্ল্যাক কাইট বা চিল। শহরের উঁচু সেকেলে বাড়ির ছাদে বা ল্যাম্পপোস্টের মাথায় গম্ভীর হাবভাব নিয়ে বসে থাকে। ওদের দেখবেন আর আন্দাজ করবেন ইঁদুর, ছুঁচো ইত্যদিরা রাস্তা পার হবার সময় ‘এই ধরে ফেল্ল রে’ গতিবেগে কেন দৌঁড়ায়। আরেকজনকে আশেপাশে ক্ষেতের পাশে বেশ দেখা যায়। দুধসাদা রং এবং লাল টকটকে চোখের কাপাসি বা ব্ল্যাক উইংড কাইট। মেঠো ইঁদুর, ছোট পাখি ইত্যাদি খেয়ে দিনাতিপাত করে। আরেকজনও বেশ কমন, শিকরা। ছোট দেহটি, কিন্তু শিকারে ভারী মজবুত।

Shikra

পূর্বস্থলীতে বাঁশের ওপর নির্ভয় হয়ে বসে ছিল শিকরা। খুব কমন একটি শিকারী পাখি। আশেপাশে বেশ দেখা যায়। দেখতে ছোট কিন্তু হেভী তেজী। দূর থেকে আমাদের নৌকা দেখেই এক পা তুলে ভয় দেখাতে থাকে।

Shikra

আরো একটা ছবি দিয়েছি একই পাখির নারকেল গাছে বসা। ওটা আমাদের ছাদ থেকে তোলা। অনেক পুরোনো ছবি। শিকরা একটা আমাদের বাড়িতে আসে প্রায়ই। সে ওই আমাদের দেখলে কুংফু পান্ডা সেজে ভয় দেখায়।
ছোট সরীসৃপ আর ছোট পাখি ধরে খায়। শিকারের স্টাইলটা সিংহের মতন। একবার শিকারের পিছু ধাওয়া করলে যদি ধরে ফেলে তাহলে হলো, নয়তো শিকার অন্যদিকে উড়ে গেলে আর ফলো টলো করেনা। রয়্যাল মেজাজ আর কি! আগেকার দিনে সাঁওতালরা বা রাজা জমিদাররা শিকরার পায়ে দড়ি বেঁধে হাতে বসিয়ে ওই দিয়ে পাখি শিকার করতেন।

পাখির জগৎ বিশাল। যে দু চারটে নাম বললাম তারা ছাড়াও আরো গন্ডায় গন্ডায় ঈগল, চিল, ফ্যালকনেট, ক্রেস্টল, হবি, হ্যারিয়ারে ভর্তি শিকারী পাখির তালিকা। সব আজকেই শুনে ফেললে আপনার ডেটা শেষ হয়ে যাবে। আসুন ডেটা শেষ হবার আগে আরো কয়েকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানিয়ে দি:
✓ পেঁচাও শিকার করে, তবে রাতে।

✓ শকুন বেচারারা শিকার করে না, মৃত দেহাংশ খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো তারা নিজেরাই মানুষের রাসায়নিক প্রীতির কারণে শিকার হয়ে বসে আছে। ভিলেনের নাম ডাইক্লোফিন্যাক। সংখ্যায় কমতে কমতে আজ তারা বিলুপ্তির দিকে পা বাড়িয়েছে। আজকাল যাঁরা পাখি ভালোবাসেন বা পাখির ছবি তোলেন তাঁরা টাকাপয়সা খরচ করে ট্রেনে, ফ্লাইটে চেপে বিভিন্ন জায়গায় যান গুটিকয়েক বেঁচে থাকা শকুন দর্শন করতে। 

✓ কাক শিকারী পাখি নয়, টুকটাক ইঁদুর ধরে খেলেও কাক মূলতঃ ঝাড়ুদার পাখি, যারা নোংরা খেয়ে পরিষ্কার করে। 

যাই হোক, কথা হচ্ছিল পাখির নমনীয়তা নিয়ে। তারা আসলে শক্তিশালী নাকি অশক্ত প্রাণী তাই নিয়ে। এই প্রসঙ্গে পরিযায়ী পাখিদের কথা না বললে অনেক কিছুই না বলা থেকে যাবে। পরিযায়ী পাখিরা রাশিয়া, চীন এইসব উত্তরের দেশ মহাদেশ থেকে শীতকালে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে যেসব ওয়েডর এবং হাঁস জাতীয় পাখি দেখা যায় তারা অধিকাংশই পরিযায়ী। কি পরিমাণ বিশাল শক্তিধর হলে এই ব্যাপক দূরত্ব অবলীলায় অতিক্রম করা সম্ভব ভাবুন। আমাদের তো দোতলা ছাড়ুন, একতলায় উঠতেও লিফ্ট হলে ভালো হয়! পথ চলার সুবিধার্থে ছোট গাড়ি, টোটো, অটো ইত্যাদি আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। আর আমুর ফ্যালকন নামের শিকারী পরিযায়ী পাখির দল রিটার্ন মাইগ্রেশন বা আফ্রিকায় শীত কাটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোত্থাও না থেমে একবারে ভারতবর্ষের উপর দিয়ে উড়ে বেড়িয়ে যায়। ভাবা যায়না তাই না! ৬০০ মাইল এক একবারে কোত্থাও না থেমে হেসেখেলে পার করে দেয় কেউ কেউ।

Bar-headed Geese

আর্কটিক টার্ন সবচেয়ে বেশী দূরত্ব মাইগ্রেট করে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব তিনবার কভার করা যায় এমন।বার হেডেড গীস বা বড়িহাঁস এভারেস্টের উপর দিয়ে  উড়ে আসে। প্রায় ২৮০০০ ফিট উচ্চতা দিয়ে।

Peregrine Falcon

এতদিন যাঁরা জানতেন চিতাবাঘ সবচেয়ে দ্রুততম প্রাণী তাঁরা জেনে রাখুন চিতাবাঘের চেয়েও দ্রুত, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির জীবন্ত স্পিসিস হলো পেরিগ্রিন ফ্যালকন। ডাইভ দেবার সময় ওড়ার স্পীড ঘন্টায় ৩২০ কি.মি। নরম কচি অসহায় অশক্ত হলে এই তুমুল শক্তির উল্লাস আমরা পেতাম না পক্ষীজগতে।

Crested-serpent Eagle

ভারতবর্ষের বিভিন্ন জঙ্গলে যে জাতীয় শিকারী পাখি দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতমগুলি হলো – ক্রেস্টেড সার্পেন্ট ঈগল, ক্রেস্টেড হক ঈগল, ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল, টাওনি ঈগল, বুটেড ঈগল, ওয়েস্টার্ন এবং ইস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার, ওরিয়েন্টাল হানি বাজার্ড, গ্রে হেডেড ফিশ ঈগল ইত্যাদি। নাম শুনে চেহারা বা খাদ্যাভ্যাসের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়, যেমন ক্রেস্টেড সার্পেন্ট সাপ ধরে খায়, মাথায় ঝুঁটির মতন উঁচু পালক, আবার গ্রে হেডেড ফিশ ঈগলের মাথা ধূসর আর জীবনের লক্ষ্য ‘মৎস মারিব, খাইবো সুখে’। হানি বাজার্ড আবার চাকভাঙ্গা মধু ভালোবাসে। অনেকসময় পাখি দেখতে গিয়ে দেখেছি, জঙ্গলে গাছের ডালে বিশাল বিশাল  মৌমাছির চাক ঝুলছে, আর সামনে ক্রমাগত আশায় আশায় উড়ে চলেছে  ওরিয়েন্টাল হানি বাজার্ড।

Grey-headed Fish Eagle

তবে শিকারী পাখি দেখার আদর্শ জায়গা জোরবীর এবং তালছাপ্পার। যেখানে খাদ্যের প্রাচুর্য সেখানেই খাদকের অবস্থান। সুতরাং শিকারী পাখি দেখা যায় যখন বা যেখানে মেঠো ইঁদুর, ছোট সরীসৃপ বা আকারে ছোট পাখি বেরোয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখির বাসাটি কিন্তু তৈরী করেছে এক শিকারী পাখি দম্পতি। আমেরিকার ফ্লোরিডায় ২০ ফিট গভীর, ২ টনের বেশী ভারী বাসাটি দুই বল্ড ঈগল স্বামী স্ত্রী তৈরী করেছে। হ্যাঁ এমন বাসাকে বাসা না বলে ইমারত কিংবা অট্টালিকা বলাই ভালো। (Source :
https://www.guinnessworldrecords.com/world-records/largest-birds-nest/ )

বল্ড ঈগলদের বিয়ের সময় পাত্র পাত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিও ভারী মজার। নারী পাখি আর পুরুষ পাখি পায়ে পায়ে আটকে আকাশে ওড়ে। উড়তে উড়তে নারী পাখি মাথা নীচে দিয়ে পুরুষের পায়ে আটকে ঝুলতে থাকেন। তারপর একসময় গ্রিপ ছেড়ে দেন। হবু বর তখন ছুটে উড়ে গিয়ে হবু বউয়ের পা আবার গ্রিপে নেন। ব্যাস ভালোবাসা প্রমাণিত হলো এবং নারী পাখিও বুঝে গেলেন যে পুরুষটি তার এবং তার ছানাপোনাদের জন্য আদৌ ভারী খাদ্য শিকার করে আনতে পারবে কিনা!বেশিরভাগ ঈগল বা হ্যারিয়ার জাতীয় পাখি জঙ্গলের হ্যাবিটেটে ২০-২৫ বছর বাঁচে। কিন্তু আবার উপযুক্ত পরিবেশে বন্ধীদশায় বাঁচে ৪০-৫০ বছর।

Osprey

পাখিরা কখনই নরম, তুচ্ছ নয় আবার তারা হিংস্রও নয়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই শিকার করে, তাও অত্যন্ত মেথডিক্যালি। রামায়ণের জটায়ু পাখির কথাই ভাবুন বা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কথাই বলুন। পৌরাণিক গল্প থেকে রূপকথা সর্বত্র রাজা, রানী, রাজপুত্র রাজকন্যাদের রাক্ষসের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কখনো বা উদ্ধার করে ডানায় বসিয়ে সাত সাগর তেরো নদী, তেপান্তর পেরিয়ে পাখিরা প্রমাণ করেছে যে তারা ‘ক্ষুদ্র তবু তুচ্ছ’ নয়। অসহায় তো নয়ই। বরং কোথাও কোথাও তারা মানুষের পরিত্রাতা।